যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান শাখা বা বিভাগসমূহ নিজ নিজ পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে এবং এদের সমষ্টিগত অবদানের দ্বারা দেশের অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে ওঠে । অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত এসব শাখা বা বিভাগকে অর্থনৈতিক খাত বলে ।
কৃষি খাত (Agriculture Sector)
কৃষিকাজ হচ্ছে ভূমিকর্ষণ, বীজ বপন, লস্য- উদ্ভিদ পরিচর্যা, ফসল কর্তন ইত্যাদি থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিস্তৃত কার্যক্রম। ফসল উৎপাদন ছাড়াও মাছ ও মৌমাছি চাষ, পশুপালন ও বনায়ন কৃষি খাতের অন্তর্ভুক্ত।
ক) শস্য ও শাকসবজি
আমাদের দেশের কৃষকেরা শস্যের মধ্যে ধান, গম, পাট, ডাল, আৰু, তামাক, চা ও তৈলবীজ ইত্যাদি আর শাকসবজির মধ্যে আলু, শিম, লাউ, মটরশুঁটি, পটল, করলা ও বেগুন ইত্যাদি উৎপাদন করে ।
খ) প্রাণিসম্পদ
আমাদের দেশে পারিবারিকভাবে ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া, কবুতর ও অন্যান্য পাখি পালন করা হয়। এদের মাংস, ডিম, দুধ, পালক ও চামড়া ইত্যাদি এ খাতের অন্তর্ভুক্ত।
গ) বনজ সম্পদ
আমাদের দেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় শতকরা ১১.১ ভাগ জুড়ে রয়েছে বনাঞ্চল, যেখানে একটি দেশের থাকা উচিত মোট ভূখণ্ডের শতকরা ২৫ ভাগ। এসব বনাঞ্চলে রয়েছে বাঁশ, বেত, শাল, সেগুন, গর্জন, সুন্দরী, গরান, গেওয়া, পামারি, কড়াই, কুচি ও কেওড়া ইত্যাদি গাছ। এগুলো থেকে কাঠ, রাবার, গাম-তৈল, শপ, মোম ও মধু ইত্যাদি আমরা পেয়ে থাকি ।
ঘ) মৎস্য সম্পদ
এ দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, হাওর ও সাগর থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মৎস্যজাত দ্রব্য পাওয়া যায় । এদেরকে আবার ২টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যেমন- মিঠা পানির মৎস্য এবং সামুদ্রিক মৎস্য। মিঠা পানির মৎস্য হলো রুই, চিতল, কই, শিং, মাগুর ইত্যাদি এবং সামুদ্রিক মৎস্য হলো, রূপচাঁদা, ভেটকি, লইট্যা ইত্যাদি । সম্প্ৰতি মৎস্য খাতে উৎপাদন প্রচুর বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার মৎস্য খাতকে একটি পৃথক খাতের মর্যাদা প্রদান করেছেন।
কৃষি খাতের অবদান বা গুরুত্ব
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কৃষি খাতের উন্নয়নের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ইত্যাদি কৃষির অগ্রগতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত । ফলে কৃষি খাতের উন্নয়নে সরকার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, দেশের সর্বত্র মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের দোরগোড়ায় কৃষি উপকরণ পৌঁছানো, সহজ পদ্ধতিতে কৃষিঋণ প্রদান, কৃষিবীমার প্রচলন ও কৃষি কার্যক্রমে ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে । আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। এ দেশের জনগণের খাদ্যের যোগানদাতা হিসেবে কৃষি খাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিল ৩৮৮.১৭ লাখ মেট্রিক টন । দেশের শ্রমশক্তির মোট ৪৫.১ শতাংশ কৃষিখাতে নিয়োজিত । কৃষি থেকে প্রাপ্ত শণ, গোলপাতা, খড়, বাঁশ, বেত ও কাঠ ইত্যাদি এ দেশের জনগণ কর্মসংস্থান, আসবাবপত্র এবং জ্বালানির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে। এছাড়া জনগণের প্রাণিজ আমিষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ, শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ এবং শিল্পজাত দ্রব্যাদির বাজার সৃষ্টি করে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করছে ।
অতএব, ২০১২-১৩ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপিতে সার্বিক কৃষি (১+২) খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ১৬.৭৭ শতাংশ এবং ১৫.৩৫ শতাংশ। কৃষি খাতের প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্য যেমন : হিমায়িত খাদ্য, কাঁচা পাট, পাটজাত দ্রব্য ও চা। আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনে সার্বিক কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির হার নিচের তালিকায় উল্লেখ করা হলো :
শিল্প খাত (Industry Sector )
প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ বা কাঁচামাল বা প্রাথমিক দ্রব্যকে কারখানাভিত্তিক প্রস্তুত প্রণালির মাধ্যমে মাধ্যমিক দ্রব্য বা চূড়ান্ত দ্রব্যে রূপান্তরিত করাকে শিল্প বলে । বাংলাদেশের জাতীয় আয় নির্ণয়ে ১৫টি খাতের মধ্যে খনিজ ও খনন; ম্যানুফ্যাকচারিং: বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি
সরবরাহ এবং নির্মাণ এ খাতগুলোর সমন্বয়ে সার্বিক শিল্প খাত গড়ে উঠেছে।
শিল্প খাতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে দেওয়া হলো :
১. খনিজ ও খনন
এ খাতের প্রধান উপখাত হলো-
ক) প্রাকৃতিক গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল
খ) অন্যান্য খনিজ সম্পদ ও খনন (কয়লা, চুনাপাথর, চীনামাটি, গন্ধক, কঠিন শিলা, সিলিকা বালু ও তামা ইত্যাদি)
২. ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প
ক) বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প : নিম্নে আলাদাভাবে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প উল্লেখ করা হলো :
বস্ত্রশিল্প, চিনিশিল্প, সারশিল্প, সিমেন্টশিল্প, জাহাজ নির্মাণশিল্প, পাটশিল্প, কাগজশিল্প প্রভৃতি বৃহৎ শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। দেশের উল্লেখযোগ্য মাঝারি শিল্প হলো, চামড়াশিল্প, তৈরি পোশাকশিল্প, সিগারেট শিল্প, প্লাস্টিক শিল্প, হোসিয়ারি শিল্প ইত্যাদি ।
খ) ক্ষুদ্রায়তন শিল্প : নিম্নে ক্ষুদ্রায়তন শিল্প দুই ভাগে উল্লেখ করা হলো :
ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরি শিল্প, দিয়াশলাই শিল্প, কাঠশিল্প, সাবানশিল্প, প্রসাধনীশিল্প এবং যানবাহন সার্ভিসিং ও মেরামতশিল্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ক্ষুদ্র শিল্প।
রেশমশিল্প, বাঁশ ও বেতশিল্প, পিতল ও কাঁসাশিল্প এবং তাঁতশিল্প ও মৃৎশিল্প উল্লেখযোগ্য কুটির শিল্প।
৩. বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি : এ খাতের উপখাত ৩টি হলো- ক. বিদ্যুৎ, খ. গ্যাস ও গ. পানি
৪. নির্মাণ শিল্প : এই খাতে অন্তর্ভুক্ত – সেতু নির্মাণ, নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও আবাসিক ও বাণিজ্যিক ঘর-বাড়ি
নির্মাণ ।
উপরিউক্ত চারটি খাতের সমন্বয়ে সার্বিক শিল্প খাত গঠিত ।
শিল্প খাতের অবদান বা গুরুত্ব
২০১২-১৩ অ ধ্বছরে দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বৃহৎ খাতসমূহের মধ্যে সার্বিক শিল্প খাতের অবদান ছিল ২৯ শতাংশ । ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সার্বিক শিল্প খাতের অবদান ৩০.৪২ শতাংশ হয়েছে। যা ২০১৫-১৬ সালে ৩১.৫৪ শতাংশ।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিল্প খাতের দ্রুত বিকাশের জন্য বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ দেশে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (EPZ) স্থাপন করেছে। যা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে দেশে শিল্প খাত বিকাশে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে আসছে।
ডিসেম্বর ২০১২ পর্যন্ত ৮টি EPZ [চট্টগ্রাম, ঢাকা, মংলা, কুমিল্লা, ঈশ্বরদী, উত্তরা (নীলফামারী), আদমজী ও কর্ণফুলী] এ ৪১২টি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনরত রয়েছে; ৩,৫০,২৬৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক সেখানে কর্মরত এবং ৪,২১০.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে ।দেশের শিল্পায়নের গতিকে বেগবান করতে সরকার শিল্পনীতি ২০১০ ঘোষণা করেছে । এ নীতির গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীকে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূল ধারায় নিয়ে আসা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার ঘটানো । উন্নয়ন রূপকল্প ২০২১ অনুযায়ী ২০২১ সালে একটি শক্তিশালী শিল্প খাত গড়ে উঠবে যেখানে জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান হবে ৪০ শতাংশ এবং মোট কর্মসংস্থানে অবদান হবে ২৫ শতাংশ ।
কৃষি, শিল্প, পরিবহন ও যোগাযোগ, গৃহস্থালি, সেবা খাতসমূহ বিভিন্ন আয়বর্ধনকারী কর্মকাণ্ডে বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেল ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই সরকার এ খাতে বিভিন্ন মেয়ানি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সকল জনসাধারণকে বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় আনার ব্যাপারে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা করেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের শতকরা প্রায় ৭১ ভাগ পুরণ করে। উৎপাদিত গ্যাসের সর্বাধিক ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। রাসায়নিক সার তৈরির কাঁচামাল রূপে, কলকারখানা, পরিবহন ও গৃহে গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ।
সিমেন্ট, কাগজ, সাবান, ব্লিচিং পাউডার উৎপাদনে চুনাপাথর বাসনপত্র ও স্যানিটারি দ্রব্য তৈরিতে চীনামাটিঃ কাঁচ ও রাসায়নিক দ্রব্য তৈরিতে সিলিকা বালু; ৰাৱণ ও দিয়াশলাই কারখানার এবং তেল পরিশোধনে গন্ধক ব্যবহৃত হয়। অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যার, সার্বিক শিল্প খাতের দ্রুত বিকাশের মাধ্যমে জাতীর আর ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার পাশাপাশি পরনির্ভরশীলতা হ্রাস করা সম্ভব।
সেবা খাত (Service Sectur
অৰ্থনৈতিক যেসব কাজের মাধ্যমে অবস্থগত সেবাকর্ম উৎপাদিত হয় অর্থাৎ যা রূপান্তরিত কাঁচামাল হিসাবে দৃশ্যমান নয় কিন্তু মানুষের বিভিন্ন অভাব পূরণ করে এবং বার বিনিমর মূল্য রয়েছে, তাকে সেবা বলে ।
পরিবহনব্যবস্থা
বাংলাদেশে পাইকারি ও খুচরা বিপশন, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ, ব্যাংক, বিনা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গৃহায়ণ, লোকপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা, কমিউনিটি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সেবাকর্ম উৎপন্ন হয়। এসব সেবা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও জনগণের নিকট সরবরাহ করা হয় এবং জনগণ এসব সেবা ক্রয় করে তাদের অভাব পূরণ করে । পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সেবা খাত হলো একক বৃহত্তম খাত । ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপিতে সার্বিক সেবা খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে ৫৩.৫৮ শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালে ৫৩.১২ শতাংশ। সার্বিক সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত উপখাতসমূহের জিডিপিতে অবদানের হার নিচের তালিকায় দেখানো হলো :
common.read_more